অন্য কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমনভাবে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস দখল করে রেখেছেন যে অন্যদিকে তাকানোই মুশকিল হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাভিশনে ‘গণতন্ত্র’ শিরোনামে মেগা টক শোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বললেন, সাম্প্রতিককালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রসহ চীন-জাপান ও অন্যান্য দেশে যে ‘সফল’ সফর হয়েছে তার পুরো গৌরব ম্লান করে দিয়েছে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর এই বক্তব্য। শুক্রবার যখন এই লেখা লিখছি, তার আগে দেখলাম ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামও প্রায় একই কথা বলেছেন। মাহফুজ আনাম আবার ভারত ও বাংলাদেশ এই দুই প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের ওপর একটা ‘পাখির দৃষ্টি’ও দিয়েছেন।
পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র সফরের ওপর প্রতিবেদনগুলো পড়ে দেখেছি। একেক পত্রিকা একেকভাবে এই সফরের বিশ্লেষণ করেছে। আমাদের দেশে এ রকমই হয় বা এখন এ রকম বেশি হচ্ছে। দ্বিদলীয়, দুর্বৃত্তায়িত অপরাজনীতির বিভাজিত ধারা পুরো সমাজকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। সংবাদমাধ্যম বা সংবাদকর্মীরাও এর থেকে বাইরে থাকতে পারছেন না। তাঁদের লেখায়, আচরণে, উচ্চারণে এই বিভাজনের ছাপ পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফর নিয়েও এই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এদের মধ্যে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনটি উল্লেখ করার মতো। যেদিন নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার মধ্যে নিউ ইয়র্কের প্যালেস হোটেলে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো, তার পর দিন কূটনৈতিক ভাষ্যকারের লেখা সংবাদটি ডেইলি স্টার তাদের প্রথম শিরোনাম করল। নরেন্দ্র মোদিকে খুবই সিরিয়াস উল্লেখ করে সংবাদদাতা লিখলেন, মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন, তিনি তিস্তার পানি সমস্যা ও স্থলসীমান্ত চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে আন্তরিক।
কূটনৈতিক পর্যায়ে আসলে এ রকম করেই কথা হয়। এভাবে বলা এক কথা, আর সমস্যা সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারা আরেক কথা। সীমান্তচুক্তি সমাধানে ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি সংবিধান সংশোধনী লাগবে। সেটা এখনো হয়নি। আর তিস্তাচুক্তি সমাধানে রাজ্য সরকারের ভূমিকা মুখ্য। এ ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি কিছু করতে পারবেন না, যেমন মনমোহন সিংও পারেননি। কূটনৈতিক সংবাদদাতা ঠিকই লিখেছেন, আসলে কোনো কনক্লুসিভ আলোচনা হয়নি দুই নেতার মধ্যে। বৈঠকটি মাত্র ২০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচ-সাত মিনিট তো প্রথম দেখার আমেজ ও সৌজন্য বিনিময় করতেই গেছে। তারপর মোদি যে বলেছেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা এনেছিলেন আর শেখ হাসিনা তাঁকে রক্ষা করেছেন। তার মৌতাতেই কেটে গেছে কয়েকটা মিনিট। তাহলে কথা বলার জন্য বাকি থাকে মিনিটদশেক। নিশ্চয়ই সেটাকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন শেখ হাসিনা। সে যোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, খেয়াল ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব তাঁর আছে। ভাগ্য ভালো, মোদি জিজ্ঞেস করেননি, ওটা কী অভিনন্দন পাঠিয়েছিলেন আমাকে নির্বাচনে বিজয়ের পর! আমার নির্বাচন নিয়ে কেউ তো কোনো প্রশ্ন তোলেননি। আর আপনার নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্ব প্রশ্ন তুলেছে। আমি বড় বিপদে আছি। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি গুজরাট নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। বাংলাদেশের খবর তো জানতাম না।
শেখ হাসিনার এই টার্মের সরকার এ প্রশ্ন নিয়েই বড় বিব্রত আছে। ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪ জন আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া- এমন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার যে এটাকে নির্বাচন বলে বিশ্বের কোথাও চালানো যাচ্ছে না। গতবারের শেখ হাসিনার সরকার যে নির্বাচিত ছিল, সেটা কাউকে বলে দেওয়ার দরকার হতো না। কিন্তু এবার দিনের মধ্যে তিনবার করে বলেও স্বস্তি পাচ্ছে না এই সরকার। ক্ষমতায় যে তারা আছে, সেটা একটা বাস্তবতা। আমেরিকা বলি, চীন-জাপান বলি, সেটা তারা অস্বীকার করবে কেমন করে? এই জন্যই এটা De Facto সরকার। এই জন্য জাপানকে জাতিসংঘের সদস্যপদ ছেড়ে দেওয়ার পরও জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই সরকার আসলে এমন কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সেটা করার প্রশ্নও আসে না; বরং যেভাবে তারা প্রশ্নবিদ্ধ, তার জবাব দিতে দিতেই তাদের পুরো সময় ব্যস্ত থাকতে হবে। লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্য শেখ হাসিনার এ সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে- এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে তাই একমত হতে পারছি না আমি। আমার কাছে বরং মনে হচ্ছে, আমার এক বন্ধু বললেন, লতিফ সিদ্দিকী শেখ হাসিনাকে সুযোগ করে দিয়েছেন এ দেশে বিশেষ করে ধর্মবাদীদের মন জয় করার। শেখ হাসিনা আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ। নিজের পুত্র-কন্যাদের বাদ দিলে রাজনীতির মাঠে তিনি কোনো প্রেম-ভালোবাসা, দয়া-দাক্ষিণ্যের চাষ করেন না। এখানে তিনি সত্যিকার অর্থেই ম্যাকিয়াভেলির মডার্ন ‘প্রিন্স’ (প্রিন্সেস)।