ঢাকা, ০৯ অক্টোবর ২০১৪।
পরে দুই বন্ধু মিলে আবার ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। শেষে ডাকাতিও সংঘটিত করেন। কিন্তু, এবার র্যাবের হাতে ধরা পড়েন তারা। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন পরিকল্পনায় ও অন্যজন ভল্ট খোলায় দক্ষ।
জয়পুরহাটের ব্র্যাক ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সাতজনকে আটকের পর এমন তথ্য দিয়েছেন।
এই দু’জন হলেন শামীম ও রাজা মিয়া। শামীমের নিখুঁত পরিকল্পনায় দুধর্ষ এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ২৬ সেপ্টেম্বর সিঁদ কেটে এই ডাকাতির ঘটনায় ব্যাংকের ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা লুট হয়।
র্যাব এই ঘটনায় সাতজন আটক ও লুট হওয়া ৫৬ লাখ টাকা উদ্ধার করে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে র্যাব সদর দফতরে এ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খাঁন। এ সময় র্যাব ও ব্র্যাক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
র্যাবের হাতে আটকরা হলেন- রাজা মিয়া (৪৫), বাদল মল্লিক ওরফে বাবলা (৪৯), মঞ্জুরুল হাছান শামীম (৩২), অনুপ চন্দ্র পণ্ডিত (২১) প্লাবন চন্দ্র পণ্ডিত (২৫), স্বপন দেবনাথ (৪০) ও এম কে কুদ্দুসুর রহমান বুলু (৫২)। আটকদের রাজধানী ও রাজধানীর বিভিন্ন জেলা থেকে আটক করা হয়।
র্যাব জানায়, আসামিদের ভাষ্যমতে, রাজা একজন ভোল্ট আনলক স্পেশালিস্ট। তিনি যে কোনো ধরনের ভোল্ট/তালা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে ভাঙার যোগ্যতা রাখেন। এ কারণে ডাকাতির পরিকল্পনায় রাজা একজন অনিবার্য সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক ডাকাতির অন্যতম মূলনায়ক রাজা মিয়া। ২০০২ সালে চট্টগ্রামের শুক্কুরের নেতৃত্বে ঢাকার ধানমন্ডির ব্র্যাক ব্যাংক, কলাবাগান শাখায় শাহেদ আলম, হানিফ ও অন্যান্য ২০/২১ জনের সহায়তায় ২৫০ ভরি সোনার অলঙ্কার লুটের সঙ্গে জড়িত।
তিনি বলেন, রাজা মিয়া ২০০২ সালে ব্র্যাক ব্যাংক কলাবাগান শাখায় সুড়ঙ্গ কেটে ভেতরে ঢুকে ভল্ট ভাঙতে না পেরে ড্রয়ারে রক্ষিত ২৫০ ভরি সোনার গহনা লুট করেন। সোনা লুটের দুইদিন পর এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজা মিয়াসহ ১৮/১৯ জন গ্রেফতার হয় এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন।
কারাগারে থাকাকালীন শামীমের সঙ্গে রাজা মিয়ার পরিচয় হয়। জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর ২০১২ সালের দিকে শামীমের সঙ্গে রাজা মিয়ার আকস্মিক দেখা হয় এবং শামীম তার মোবাইল ফোন নম্বর রাজা মিয়াকে যোগাযোগ করার জন্য বলেন।
ঈদ-উল-আজহার ২০ থেকে ২৫ দিন আগে রাজা মিয়ার সঙ্গে শামীমের ফোনে যোগাযোগ হয় এবং শান্তাহারে গিয়ে ব্যাংক ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাজ, নওশের, ইসলাম, ইকবাল, বুলু ও স্বপনের সঙ্গে জয়পুরহাটে ভাড়া বাসায় পরিচয় হয়।
মুফতি মাহমদু খাঁন জানান, ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা থাকলেও টানা হরতালের কারণে ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। শামীম, রাজা মিয়া, নওশের, ইসলাম ও তাজ এই চক্রটি সাধারণত জুয়েলারি, ব্যাংক যেখানে নিরাপত্তা কিছুটা দুর্বল, সে ধরনের স্থান খুঁজে বের করে ডাকাতির টার্গেট নির্ধারণ করতেন।
এরই ধারবাহিকতায় ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী শামীম ও রাজা মিয়া তেমনই একটি টার্গেট হিসেবে জয়পুরহাটের ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা নির্বাচন করেন। ডাকাতির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১২ সেপ্টেম্বর ব্যাংক সংলগ্ন একটি ঘর বাংলাদেশ পৌর ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে এক ভুয়া এনজিও’র অফিস দেখিয়ে ভাড়া নেন।
পরিকল্পনা মোতাবেক শামীম মালিকের সঙ্গে ঘর ভাড়া করার ব্যাপারে চুক্তি করেন এবং বুলুকে ভাড়ার ৫/৬ হাজার টাকা দিয়ে ঘর মালিকের কাছে দিতে বলেন। বুলু টাকা দিয়ে দোকানের চাবি ইসলামকে বুঝিয়ে দেন। কুদ্দুসুর রহমান বুলু মূলত একজন দর্জি এবং বরিশালে বসবাস করেন। এই পেশায় সে এই প্রথম জড়িয়ে পড়েন। ডাকাতি করার আনুমানিক ১০/১৫ দিন আগে রাজা মিয়া তার পূর্ব পরিচিত স্বপনকে দেওয়াল কাটার লোক নিয়ে আসতে বলেন।
স্বপন দেবনাথের সঙ্গে রাজা মিয়ার পরিচয় আহমেদবাগ বৌদ্ধমন্দির এলাকায় একটি চায়ের দোকানে ২/৩ বছর আগে। ওই পরিচয়ের সূত্র ধরেই মোবাইল ফোনে রাজা মিয়ার সঙ্গে এই ডাকাতির ব্যাপারে যোগাযোগ হয়। স্বপন দেবনাথের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ি গ্রামে।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্বপন চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা, ইপিজেডসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সাধারণ আনসার সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। সে সুবাদে মাইক্রোবাসচালক নওশেরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার সূত্রে স্বপন, তাজ, নওশের দেওয়াল কাটার কাজ হিসেবে জয়পুরহাটে যান।
ডাকাতির প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে ইসলাম তাজ স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেওয়াল কাটার কাজ শুরু করেন এবং এই কাজ শেষ করতে তাদের প্রায় ৬ দিন সময় লাগে। দেওয়াল কাটার পর ব্র্যাক ব্যাংকে প্রবেশ করার মতো সুড়ঙ্গ তৈরি করেন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে তাজ মাহমুদ ও নওশের ব্যাংকে প্রবেশ করে সিসি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এবং তার কিছুক্ষণ পরই রাজা মিয়া ও ইসলাম আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে ভোল্টে প্রবেশ করেন এবং ভোল্টের তালা ভেঙে ফেলেন। ভল্টের তালা ভাঙার পর ভেতরে সাজানো ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা তারা কয়েকটি ব্যাগে ভর্তি করেন এবং ভাড়া করা ব্যাংক সংলগ্ন রুমে নিয়ে যান। পরবর্তীতে লুট করা টাকা পার্শ্ববর্তী ঘরে ভাগাভাগি করে নেন এবং বিভিন্নজন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, ডাকাতির পর রাজা ৩১ লাখ, শামীম ৩৩ লাখ, ইসলাম ১২ লাখ ৫০ হাজার, তাজ মাহমুদ ৮ লাখ, এমকে কুদ্দুসুর রহমান বুলু ও ইকবাল ৩৩ লাখ, স্বপন ১৮ লাখ, নওশের ১৪ লাখ ও বাদল ৯ লাখ টাকা ভাগ পান।
তিনি জানান, এই ঘটনায় আরো কয়েকজন জড়িত রয়েছেন। তাদের আটক করতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।